
লেখক: রেজুয়ান হাসান
যে বাড়ির জানালায় শৈশব আটকে থাকে,
সে বাড়ি ফেলে যাওয়া যায়,
ভুলে যাওয়া যায় না।
রাতের শহরটা যেনো নিঃশব্দ সন্ত্রাস।
ছাদে বসে এক কাপ গরম রং চায়ে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে পুরনো দিনের একটা লাইন মাথায় আসলো,
এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর এক জীবনে গল্পগুলো লিখতে মন মনে না, তবুও কেহ জানি তবুও লিখি।
একটা লাইন লিখি, আর কাগজ ছিঁড়ে ফেলি।
লিখতে পারছি না, কারণ গল্পটা একেবারেই আমার।
একেবারেই সত্য।
আর সত্য জিনিস লিখতে গেলে হাত কাঁপে।
আমি রাজ পল্লব। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে গল্প লিখতে লিখতে মানুষ হয়েছি। লেখক হয়েছি, তবু মাঝে মাঝে কলম ধরতে ইচ্ছে করে না। কাগজ ভরে ওঠে, আবার ছিঁড়ে ফেলা হয়। এতগুলো বই লিখে ফেলেছি, শহরের পাঠক চিনে, তবু আমার নিজের জন্মভূমির ধুলো গায়ে মাখিনি অনেক বছর।
তবুও ঘুম আসে না।
আজ যেনো বাবা মার মুখ বারবার চোখে ভাসছে।
পুরনো বাড়িটার সিঁড়িতে বসে থাকা একটা ছোট্ট ছেলের চোখে আমি নিজেকে দেখছি।
সিদ্ধান্ত নিলাম।
কাল গ্রামে যাব।
বাড়ি।
আমার নিজের বাড়ি।
পঁচিশ বছর পর।
সকালে ঘুম ভাঙে পাখির কিচিরমিচিরে।
শহরের ব্যস্ততা আজ একটু উপেক্ষা করলাম।
ল্যাপটপ, ক্যামেরা, পুরনো কিছু চিঠি আর বাবার দেয়া চাবিটা নিয়ে একটা ব্যাগ গুছিয়ে ছোট্ট একটা মাইক্রো রিজার্ভ করলাম।
লোকেশন অনুযায়ী একটা বাজারে এসে ড্রাইভার বললো,
ভাই, ঠিকানা তো এই বাজার পর্যন্তই।
আমি জানি।
আমার গ্রামের রাস্তাঘাট, বাড়ির ঠিকানা,সব যেনো মন থেকে মুছে গেছে।
তবুও নামলাম।
হাঁটলাম।
জিজ্ঞেস করলাম
কাকা, পাকা বড় বাড়িটা কোনদিকে?
এক বৃদ্ধ চোখ তুলে বললেন,
সোজা গিয়ে ডানে। ও বাড়িতে কেও থাকে না, ভূতুড়ে হয়ে গেছে।
আমি হেসে বললাম,
জানি।
আমি সেই বাড়ির ছেলে।
পঁচিশ বছর পর ফিরলাম।
বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইলাম।
এই সেই উঠোন।
যেখানে দাঁড়িয়ে বাবা একদিন বলেছিলেন,
তুই একদিন লেখক হবি।
এই সেই পুকুর, যার ঘাটে বসে প্রথম কবিতা লিখেছিলাম।
তখন আমি মাত্র ছয়।
ঘরে ঢুকে পড়লাম।
চাবিটা এখনও ঠিকমতো কাজ করে।
ভেতরে ঢুকতেই ঘ্রাণটা পেলাম
পুরনো ধুলোর, ছেড়া চিঠির, লুকানো স্মৃতির গন্ধ।
ঘর অন্ধকার, তবে বিদ্যুৎ আছে।
সুইচ টিপতেই ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে গেলো ছাদ থেকে।
জাল, পোকামাকড়, দেয়ালে বাবার ছবি।
একটা ফ্রেমে মা হাসছেন, পাশে আমি
ছোট্ট, চোখে স্বপ্ন।
বাইরে বেরিয়ে পুকুরঘাটে গেলাম।
দুজন কিশোর সিগারেট টানছে।
একজন বললো,
ভাই, আপনার বাড়ি কোথায়?
আমি হেসে বললাম,
এই যে, এই পাকা বড় বাড়িটাই আমার বাড়ি।
ওরা বিস্ময়ে তাকালো।
আপনি তো আগে কখনও আসেননি।
হ্যাঁ। শহরে ছিলাম। মা বাবা মরে যাওয়ার পর আর আসা হয়নি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
তোমরা কি একটু কাজ করবে? ঘরটা খুব ময়লা, পরিষ্কার করতে চাই।
তপু ও অরুণ এই দুই ছেলের চোখে একটা দ্বিধা।
এই বাড়ি কেউ আসে না ভাই। লোকজন বলে ভালো না।
আমি হেসে বললাম,
আমি তো আছি। এই বাড়ির ছেলেই তো আমি।
ঘর পরিষ্কার করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এলো।
আলমারির তালা এখনও লাগানো, বেঠক ঘরের টেবিল জড়ানো ধুলোয়, সিন্ধুকে পুরনো কাগজপত্র।
তপু হঠাৎ বলে,
ভাই, এই প্রথম এই বাড়িতে ঢুকছি। গা ছমছম করে।
আমি বললাম,
এই বাড়ি একদিন আবার জেগে উঠবে।
তাদের ৫০০ টাকা দিলাম।
তারা হতভম্ব।
ভাই, এত টাকা?
তোমাদের মেহনতের দাম বুঝি না আমি?
চলে যাওয়ার সময় বললাম,
কাল আবার এসো।
তপু চলে যাচ্ছিল, আম গাছের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
আমি বললাম,
নিয়ে যাও। কয়েকটা আম। এই গাছও তো আমার।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সন্ধ্যাগুলো গাঁওয়ের।
আমি হাঁটছি বাজারের দিকে।
পেটে খিদে, কিন্তু মনে অন্যরকম শান্তি।
পঁচিশ বছর পর ফিরে পাওয়া একটা ভূতের বাড়ি আসলে আমার ফেলে আসা জীবন।
আর এইবার আমি লিখবো।
সব লিখে ফেলবো।
যা আজও কেউ জানে না।
আসছে আগামী পর্ব