, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
কলমাকান্দায় স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার পর স্বামীর আত্মহত্যা। কলমাকান্দায় ১৭ বছর পর বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত। ময়মনসিংহে মৃত্তিকার বিভাগীয় কার্যালয় ও গবেষণাগার উদ্বোধন করেন মহাপরিচালক। আগের আমলের সেই মাফিয়াদেরকে একটি রাজনৈতিক দল প্রশ্রয় দিচ্ছে : নাহিদ ইসলাম।  অস্বাভাবিক গরমে ভুগছেন সারাদেশের মানুষ। আপনার ফোনে কোন ভার্সনের LMC বা GCam সাপোর্ট পাবে এবং কিভাবে সেই ভার্সন ডাউনলোড করবেন অতি সহজেই তা দেখে নিন!! জামালপুর সদর পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড দাপুনিয়া জলাশয়ে অর্ধগলিত অজ্ঞত’নামা এক মৃত দেহ উদ্ধার। নিখোঁজ যুবদল নেতা শামীমের পরিবারের পাশে ড. রফিকুল ইসলাম হিলালী।৩ দিনের মধ্যে খোঁজ না মিললে লাগাতার কর্মসূচির হুঁশিয়ারি। ঈশ্বরগঞ্জে গলাকেটে রাকিব হত্যা, মামাতো ভাইসহ অন্যান্য মামলার আসামী গ্রেপ্তার -৬। কেন্দুয়ায় নিখোঁজ যুবদল নেতা শামীম এর পরিবারের পাশে ডক্টর রফিকুল ইসলাম হিলালী।

পলাশীর প্রান্তরে আত্মপরিচয়ের পরাজয়: এক জাতির মানসিকতার নির্লজ্জ ইতিহাস

শাহ আলী তৌফিক রিপন, সাংবাদিক ও লেখক দৈনিক সাম্যবাদী নিউজ ডেস্ক।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত হয়েছিল শুধু নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী নয়—পরাজিত হয়েছিল একটি জাতির আত্মবিশ্বাস, চেতনা ও সম্মানবোধ। আমরা আজও সেই হার থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি। ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়ের মূল কারণ ছিল না শুধুই বিদেশি শক্তির অস্ত্র বা ষড়যন্ত্র, বরং ছিল আমাদের নিজেদের ভেতরের দুর্বলতা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং আত্মমর্যাদাহীন মানসিকতা।

নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যখন বন্দী করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ প্রতিবাদ করেনি, কেউ একটি ঢিলও ছোড়েনি। বরং অনেকেই সে দৃশ্যকে ‘বিনোদন’ হিসেবে দেখেছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন, লর্ড ক্লাইভ নিজেই ডায়েরিতে লিখেছেন—“যদি সে সময় প্রত্যক্ষদর্শী প্রত্যেক ব্যক্তি একটি করে ঢিল ছুঁড়তো, তবে ইংরেজদের পরাজয় নিশ্চিত ছিল।”

সিরাজের কাছে ছিল বিশাল সেনাবাহিনী—১০ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক, অসংখ্য কামান ও গোলাবারুদ। আর ক্লাইভের হাতে ছিল মাত্র ৩ হাজার সৈন্য, তাও বেশিরভাগ অপেশাদার ও যুদ্ধ-অভিজ্ঞতাহীন। তা সত্ত্বেও ক্লাইভ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কেন? কারণ তিনি নিখুঁতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালির মানসিক কাঠামো—স্বার্থপর, দ্বিধাগ্রস্ত, হীনমন্য এবং নেতৃত্বহীন।

তিনি জানতেন, একটি জাতিকে পরাজিত করতে কেবল বাহুবলের প্রয়োজন নেই; মনস্তত্ত্বের সঠিক ব্যবচ্ছেদই যথেষ্ট। এই জাতি মুখে সাহসের বুলি আউড়ায়, কিন্তু প্রয়োজনে মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রতিবাদ নয়, তামাশা উপভোগ করতেই বেশি পছন্দ করে। রবার্ট ক্লাইভ তাই বুঝেছিলেন, মীরজাফরদের মত স্বার্থান্বেষীদের ফাঁদে ফেললেই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যাবে।

পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হলেও ক্লাইভ খুব ভালো করেই জানতেন, যাদের বিশ্বাসঘাতকতা দিয়ে জয় এসেছে, তাদের পরিণতিও ভয়াবহ হবে। এবং তাই হয়েছে—মীরজাফর, উমিচাঁদ, রায়বল্লভ, ঘষেটি বেগম—প্রত্যেকেই ইতিহাসের জঘন্য পরিণতির শিকার হয়েছে।

এখানে ভাবার বিষয় হলো, একটি জাতি কীভাবে নিজের বীরকে অপমানিত হতে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? কীভাবে নিজেকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে স্বেচ্ছায় বন্দী করে রাখে? পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পতন ছিল এক প্রতীকী ঘটনা—যা দেখিয়ে দিয়েছিল, আমরা কেবল পরাজিত হইনি, আত্মসম্মানও বিসর্জন দিয়েছিলাম।

আজ, আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি, কিন্তু সেই মানসিক গোলামির শিকল কি আমরা ভাঙতে পেরেছি? আজও কি আমরা ভেতর থেকে মুক্ত? আত্মসম্মানে বলীয়ান? ইতিহাস শুধু স্মরণ করার জন্য নয়, শিক্ষা নেওয়ার জন্য। পলাশী আমাদের শেখায়—স্বাধীনতা শুধু বাহ্যিক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই নয়, আত্মবিশ্বাসহীনতার বিরুদ্ধে নিজের ভেতরের যুদ্ধও।

রবার্ট ক্লাইভ ইতিহাসে একজন বিজেতা হিসেবে চিহ্নিত, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল—একটি জাতির মনস্তত্ত্ব এত নিখুঁতভাবে বোঝা, যা দিয়ে একটি পরাক্রমশালী জাতিকে বিনা রক্তপাতে দাসে পরিণত করা যায়।

তাই বলা যায়, ইতিহাসের সবচেয়ে নিখুঁত বাঙালি-মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষক ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। তিনি বুঝেছিলেন—এই জাতিকে বন্দী করতে কামান নয়, দরকার কেবল একটি আয়না—যেখানে তারা নিজের বিভাজন, আত্মপ্রবঞ্চনা ও কাপুরুষতা স্পষ্ট দেখতে পায়।

আজ আমাদের করণীয়—সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা, আমরা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? স্বাধীন, না কেবল এক নতুন রূপের পরাধীনতায় অভ্যস্ত?

জনপ্রিয়

কলমাকান্দায় স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার পর স্বামীর আত্মহত্যা।

পলাশীর প্রান্তরে আত্মপরিচয়ের পরাজয়: এক জাতির মানসিকতার নির্লজ্জ ইতিহাস

প্রকাশের সময় : ০৫:৫৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫

শাহ আলী তৌফিক রিপন, সাংবাদিক ও লেখক দৈনিক সাম্যবাদী নিউজ ডেস্ক।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত হয়েছিল শুধু নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী নয়—পরাজিত হয়েছিল একটি জাতির আত্মবিশ্বাস, চেতনা ও সম্মানবোধ। আমরা আজও সেই হার থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি। ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়ের মূল কারণ ছিল না শুধুই বিদেশি শক্তির অস্ত্র বা ষড়যন্ত্র, বরং ছিল আমাদের নিজেদের ভেতরের দুর্বলতা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং আত্মমর্যাদাহীন মানসিকতা।

নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যখন বন্দী করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ প্রতিবাদ করেনি, কেউ একটি ঢিলও ছোড়েনি। বরং অনেকেই সে দৃশ্যকে ‘বিনোদন’ হিসেবে দেখেছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন, লর্ড ক্লাইভ নিজেই ডায়েরিতে লিখেছেন—“যদি সে সময় প্রত্যক্ষদর্শী প্রত্যেক ব্যক্তি একটি করে ঢিল ছুঁড়তো, তবে ইংরেজদের পরাজয় নিশ্চিত ছিল।”

সিরাজের কাছে ছিল বিশাল সেনাবাহিনী—১০ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক, অসংখ্য কামান ও গোলাবারুদ। আর ক্লাইভের হাতে ছিল মাত্র ৩ হাজার সৈন্য, তাও বেশিরভাগ অপেশাদার ও যুদ্ধ-অভিজ্ঞতাহীন। তা সত্ত্বেও ক্লাইভ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কেন? কারণ তিনি নিখুঁতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালির মানসিক কাঠামো—স্বার্থপর, দ্বিধাগ্রস্ত, হীনমন্য এবং নেতৃত্বহীন।

তিনি জানতেন, একটি জাতিকে পরাজিত করতে কেবল বাহুবলের প্রয়োজন নেই; মনস্তত্ত্বের সঠিক ব্যবচ্ছেদই যথেষ্ট। এই জাতি মুখে সাহসের বুলি আউড়ায়, কিন্তু প্রয়োজনে মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রতিবাদ নয়, তামাশা উপভোগ করতেই বেশি পছন্দ করে। রবার্ট ক্লাইভ তাই বুঝেছিলেন, মীরজাফরদের মত স্বার্থান্বেষীদের ফাঁদে ফেললেই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যাবে।

পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হলেও ক্লাইভ খুব ভালো করেই জানতেন, যাদের বিশ্বাসঘাতকতা দিয়ে জয় এসেছে, তাদের পরিণতিও ভয়াবহ হবে। এবং তাই হয়েছে—মীরজাফর, উমিচাঁদ, রায়বল্লভ, ঘষেটি বেগম—প্রত্যেকেই ইতিহাসের জঘন্য পরিণতির শিকার হয়েছে।

এখানে ভাবার বিষয় হলো, একটি জাতি কীভাবে নিজের বীরকে অপমানিত হতে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? কীভাবে নিজেকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে স্বেচ্ছায় বন্দী করে রাখে? পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পতন ছিল এক প্রতীকী ঘটনা—যা দেখিয়ে দিয়েছিল, আমরা কেবল পরাজিত হইনি, আত্মসম্মানও বিসর্জন দিয়েছিলাম।

আজ, আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি, কিন্তু সেই মানসিক গোলামির শিকল কি আমরা ভাঙতে পেরেছি? আজও কি আমরা ভেতর থেকে মুক্ত? আত্মসম্মানে বলীয়ান? ইতিহাস শুধু স্মরণ করার জন্য নয়, শিক্ষা নেওয়ার জন্য। পলাশী আমাদের শেখায়—স্বাধীনতা শুধু বাহ্যিক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই নয়, আত্মবিশ্বাসহীনতার বিরুদ্ধে নিজের ভেতরের যুদ্ধও।

রবার্ট ক্লাইভ ইতিহাসে একজন বিজেতা হিসেবে চিহ্নিত, কিন্তু তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল—একটি জাতির মনস্তত্ত্ব এত নিখুঁতভাবে বোঝা, যা দিয়ে একটি পরাক্রমশালী জাতিকে বিনা রক্তপাতে দাসে পরিণত করা যায়।

তাই বলা যায়, ইতিহাসের সবচেয়ে নিখুঁত বাঙালি-মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষক ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। তিনি বুঝেছিলেন—এই জাতিকে বন্দী করতে কামান নয়, দরকার কেবল একটি আয়না—যেখানে তারা নিজের বিভাজন, আত্মপ্রবঞ্চনা ও কাপুরুষতা স্পষ্ট দেখতে পায়।

আজ আমাদের করণীয়—সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা, আমরা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? স্বাধীন, না কেবল এক নতুন রূপের পরাধীনতায় অভ্যস্ত?