
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয় সরকার—‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ (Food for Work Programme) নামে একটি কর্মসূচি চালু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল একদিকে দরিদ্র, কর্মহীন মানুষকে খাদ্য সহায়তা প্রদান, অন্যদিকে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করা। তখন এই কর্মসূচি হয়েছিল দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম ভরসা। তবে বর্তমানে সেই মহৎ উদ্যোগ নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ছিল—প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষের সময় দরিদ্রদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা,গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা,রাস্তা নির্মাণ, খাল খনন, মাটি কাটা ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কাজে স্থানীয় শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করা
দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখা
এই কর্মসূচি শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প ছিল না; এটি ছিল একটি মানবিক উদ্যোগ যা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি বহন করত।
বর্তমানে এই কর্মসূচির বাস্তবায়নের ধরন দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—এই প্রকল্প কি আদৌ আর দরিদ্র মানুষের কল্যাণে কাজ করছে? সরেজমিনে বিভিন্ন উপজেলায় দেখা গেছে, যেসব উন্নয়ন কাজ এই প্রকল্পের অধীনে হওয়ার কথা, সেগুলো এখন মেশিন নির্ভর হয়ে পড়েছে। মাটি কাটা, রাস্তা নির্মাণ বা খাল খননের কাজে এখন আর গরিব মানুষদের দেখা যায় না; বরং ‘বেকু’ বা ‘এক্সকাভেটর’ মেশিন দিয়েই কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
এর ফলে প্রকৃত শ্রমিকরা যেমন কাজ পাচ্ছেন না, তেমনি সরকারের দেওয়া খাদ্য সহায়তাও চলে যাচ্ছে অন্য খাতে। অথচ প্রকল্পের কাগজপত্রে দেখানো হয় শত শত শ্রমিক কাজ করছেন—এ এক ভয়ংকর দুর্নীতির আলামত। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর অনেকেই এসব অনিয়ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই বললেই চলে।
অবকাঠামো উন্নয়নে যন্ত্রপাতির ব্যবহার অবশ্যই সময় ও খরচ সাশ্রয় করে, তা অস্বীকার করা যায় না। তবে যে প্রকল্প দরিদ্র মানুষের জন্য, সেই প্রকল্পে যদি মানুষই না থাকে, তাহলে সেই প্রকল্পের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এভাবে প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
যন্ত্র দিয়ে উন্নয়ন কাজের গতি বাড়ানো গেলেও, তার মাধ্যমে যদি সমাজের দরিদ্র শ্রেণি বঞ্চিত হয়, তাহলে এটি মানবিক বিপর্যয়ের নামান্তর। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি যেন ‘নামে মানুষ, কাজে মেশিন’ প্রকল্পে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান বাস্তবতায় এই কর্মসূচিকে সময়োপযোগী করা জরুরি। প্রযুক্তির ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করে এমন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যেখানে নিশ্চিত করা হবে প্রকৃত দরিদ্র মানুষের অংশগ্রহণ। প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পে কাজের শতকরা কত ভাগ মানুষ করবে আর কত ভাগ যন্ত্রের সহায়তা নেওয়া যাবে—এমন একটি স্পষ্ট কাঠামোও প্রয়োজন।
একইসঙ্গে প্রয়োজন তদারকি বাড়ানো, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা এবং প্রকৃত উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচি এক সময় মানুষের মুখে হাসি ফিরিয়েছিল, দুর্দশার মাঝে আশার আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই কর্মসূচি যেন দাপ্তরিক কাগজে সীমাবদ্ধ একটি আনুষ্ঠানিকতা। মানবিক এই প্রকল্পকে প্রাণ ফেরাতে হলে প্রয়োজন সাহসী পদক্ষেপ, সময়োপযোগী সংস্কার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি।
এই প্রকল্পকে বাঁচানো মানে—দরিদ্র মানুষকে বাঁচানো, মানবিকতাকে টিকিয়ে রাখা।
শাহ আলী তৌফিক
স্টাফ রিপোর্টার সাম্যবাদী
১৫/০৭/২০২৫ ইং