
শাহ আলী তৌফিক রিপন ,বিশেষ প্রতিনিধি।
সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমুল ইউনিয়নের কুমরুড়া গ্রামে কথিত ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’-এর একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে এক হিন্দু নারীকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে শোনা যায়—“৭১ সালের পরেও এমন অবস্থা ছিল না। মাত্র ১০ মিনিট সময় দিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।” এই ভিডিও ঘিরে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে উত্তেজনা ছড়ালেও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে একেবারেই ভিন্ন বাস্তবতা।
সরেজমিন তদন্ত, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং নিরপেক্ষ প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনাটি ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক সম্পত্তি ও দাম্পত্য সম্পর্কঘটিত বিরোধের বহিঃপ্রকাশ। ভুক্তভোগী পরিবার এবং স্থানীয়দের বরাত অনুযায়ী, মূল অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন মো. রাব্বী (২০), যিনি ভুক্তভোগী পরিবারের নিকটাত্মীয় তথা আপন ভাগ্নে। দীর্ঘদিন ধরেই জমি ও বসতবাড়ি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে এই বিবাদ সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা নিশ্চিত করেছেন, এই ঘটনায় ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কোনো নির্যাতনের বিষয় নেই। এমনকি ভিডিওতে আবেগঘন মন্তব্য থাকলেও, বাস্তবে রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত হামলার প্রমাণ মেলেনি।
১৭ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, বলাইশিমুল ইউনিয়নের কুমরুড়া গ্রামে একটি বড় পরিসরের দরবারে উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষ-রফা হয়। ওই দরবারে উপস্থিত ছিলেন বলাইশিমুল ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আলী আকবর তালুকদার মল্লিক, চিরাং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুব আলম জরিপ, পৌর বিএনপি নেতা জসিমউদদীন খোকন,নওপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাজু, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দুয়া শাখার আমীর আবু সাদেক, বলাইশিমুল ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইদ্রিস মেম্বার, নওপাড়া ইউনিয়ন বি এন পি সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন সালাম, মানবাধিকার কর্মী শাহ আলী তৌফিক রিপন ,প্যানেল চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবিরসহ গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং স্থানীয় সাংবাদিকবৃন্দ।
দরবারে হিন্দু পরিবারটির কর্তা শিবনাথ চক্রবর্তী নিজেই স্বীকার করেন যে, ঘটনাটিকে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ হিসেবে উপস্থাপন করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। তিনি এর জন্য উপস্থিত জনতার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এই ঘটনার পটভূমি বিশ্লেষণে দেখা যায়, একটি পারিবারিক কলহকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইস্যুতে রূপ দেওয়ার অপচেষ্টা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংখ্যালঘু নির্যাতন একটি অতি সংবেদনশীল এবং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়। একে ঘিরে মিথ্যা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা দেশের সামাজিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
একইসঙ্গে, এ ধরনের তথ্য যাচাইবিহীন প্রচার সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থী এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সমতুল্য।
ঘটনাটির যথাযথ অনুসন্ধানে স্থানীয় প্রশাসনের তদন্ত এখনও চলমান রয়েছে এবং আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। প্রশাসনের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, হিন্দু পরিবারটি বর্তমানে নিরাপদ স্থানে রয়েছে এবং তাদের মৌলিক সুরক্ষার বিষয়ে কোনো আপোষ করা হয়নি।
এই ঘটনাকে ঘিরে যে বিকৃত প্রচার চালানো হয়েছে, তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই নয়—একটি স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থায় অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তেজনা তৈরি করার অপচেষ্টা হিসেবেও বিবেচিত।
জনগণ ও গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে, যেকোনো ধরনের আবেগতাড়িত তথ্য শেয়ার করার আগে যথাযথভাবে সত্য যাচাই করুন এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার মানদণ্ড অনুসরণ করুন।
“সংঘাত নয়, সম্প্রীতি হোক মূলমন্ত্র” — এই বিশ্বাসে আমাদের সকলকে সচেতন, দায়িত্বশীল ও তথ্যনির্ভর হতে হবে। একটি মিথ্যা প্রচারণা যেমন হাজারো মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি একটি সত্য প্রতিবেদন হতে পারে শান্তি ও সহমর্মিতার ভিত্তি।